
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, ব্যাংক এশিয়া লি.
দেশের চলমান ব্যাংকিং সেক্টর এবং অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হন ব্যাংক এশিয়া লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আরফান আলী এবং বিকাশ এর চিফ এক্সটারনাল অ্যান্ড কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মেজর জেনারেল (অব.) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজু আলীম
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ এর ফিন্যান্সিয়াল এক্সেস সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ৬৭টি ব্যাংক ছিল আর ৫ বছরের ব্যবধানে তা ৭৭টি হয়েছে। ব্যাংকের শাখা বাড়ছে- এটি কি ইতিবাচক?
মো. আরফান আলী : অবশ্যই এটি ইতিবাচক পরিবর্তন। কারণ ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের দুই তিনটি ধাপের মধ্যে প্রথম হচ্ছে ব্যাংক আপনার কাছাকাছি থাকবে। সুতরাং সংখ্যা বাড়ছে মানে ব্যাংক আরও জনগণের কাছে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে তারা লো কস্ট সার্ভিস দিবে। সুতরাং ব্যাংকের শাখা এবং সংখ্যা যখন বাড়বে তখন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তারা কিন্তু কম খরচে জনগণকে সেবা দিতে পারবে। তাই এই অর্থে আমরা এটাকে অবশ্যই ইতিবাচক মনে করি। কারণ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ব্যাংকের শাখা সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। আমাদের প্রতি বর্গকিলোমিটারে যত ব্র্যাঞ্চ থাকা দরকার ততগুলো শাখা এখনো করা সম্ভব হয়নি। তাই অবশ্যই এটি ইতিবাচক লক্ষণ। আমি মনে করি এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
আপনারা এজেন্ট ব্যাংকিং করছেন। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের অবদান কতটা?
মো. আরফান আলী : অবশ্যই এজেন্ট ব্যাংকিংয়েরও একটা বড় ভূমিকা আছে। এজেন্ট ব্যাংকিং যে শুধু গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে যাচ্ছে তা নয়-এটাকে ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি বলে অর্থাৎ আর্থিক শিক্ষা, এই জিনিসটাও ছড়াচ্ছে। আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মানুষ জানতে পারছে। এই কারণে তারা ব্যাংকমুখী হচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিং এসেছে সেই ধারণা থেকে- গ্রামের লোকেরা যারা আন ব্যাংকড ছিল। তাদের কিছু ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসির প্রয়োজন পড়বে এবং তার সঙ্গে তাকে ফুল ব্যাংক সার্ভিস একটি একাউন্ট দিতে হবে। এর ফলে অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যেও সাড়া পড়েছে, প্রতিযোগিতা এসেছে। এই প্রতিযোগিতার কারণে গ্রাহককে ব্যাংকমুখী করতে ব্যাংকগুলো ঝুঁকেছে। একে ফাইন্যান্সিয়াল ব্রডেনিং বলে, বেইজ অব দ্যা পিরামিড-এটি ছড়িয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সাসটেইন ফাইন্যান্সের বিরাট ভিত্তি এখানে তৈরি হচ্ছে। আমার মনে হয়- সামনের দিনগুলোতে এজেন্ট ব্যাংকিং, বিকাশের ওয়ালেট এবং তার সঙ্গে অন্যান্য ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিংও ছড়াবে। খুব তাড়াতাড়ি সব মানুষের কাছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়ে আমরা পৌঁছাতে পারব এবং তা দেশের উন্নয়নের জন্যে বড় ইতিবাচক দিক হবে।
কৃষি ব্যাংক আছে- কৃষি ব্যাংকের নতুন সংস্করণ হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিং আবির্ভূত হলো?
মো. আরফান আলী : কৃষি ব্যাংকিংও আধুনিক ছিল। একটা বিষয় আছে- টেকনোলজির ব্যবহার। আমরা টেকনোলজির ব্যবহার করেছি বেশি। এর ফলে কৃষকের কাছে পৌঁছানো আমাদের জন্যে সহজ হয়েছে এবং খুব কম খরচে তাদের কাছে আমরা যেতে পারছি। পরিবর্তন দ্ইু জায়গায় এসেছে- টেকনোলজি আর বিজনেস মডেল। প্রযুক্তির ব্যবহারে স্বচ্ছতা, গতি ও বিশ্বস্ততা এসেছে। আর বিজনেস মডেল পরিবর্তনের কারণে খরচ কম হয়েছে। যেমন, পার্টনারশিপের কারণে আমরা যে বুথ তৈরি করছি, তাতে ব্যাংকের খরচ খুব কম হচ্ছে। এজেন্ট অধিকাংশ খরচ বহন করে। তাতে ব্যাংকের ফিক্সড কস্ট তেমন কিছু থাকছে না। যেটা আসছে তা হলো চার্জ । এটি অপারেশনাল কস্টের অংশ। সুতরাং ব্যাংক সহজেই সেখানে যেতে পারছে। এই কারণে কৃষি লোন-এক সময় কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো ছোট লোন বলে অবহেলা করত কিন্তু এখন সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গেছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আরেকটু আধুনিকায়ন করেছে এজেন্ট ব্যাংকিং।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে টাকা মার যাওয়ার সম্ভাবনা বা গ্রাহকরা ঠিকমতো তাদের টাকা পায় কিনা?
মো. আরফান আলী : হ্যাঁ। এর জন্যে আমাদের অনেকগুলো সেফ গার্ড নিতে হয়। অবশ্যই আমাদের দায়িত্ব যদি কোনো এজেন্ট গ্রাহকের টাকা তছরুপ বা নষ্ট করে তার দায়ভার ব্যাংকের। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনে ষ্পষ্ট উল্লেখ আছে। তাই এখানে প্রিন্সিপাল এবং এজেন্ট এই দুইটা রিলেশনশিপ কাজ করে। এজেন্ট যদি কোনো কাজ করে তাহলে তার দায় প্রিন্সিপালকে বহন করতে হবে, কিন্তু ব্যাংকের কোনো দায় এজেন্টকে বহন করতে হয় না। তাই যে ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং করছে তারা পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই কাজ করছে। এবং আমরা সতর্ক থাকি যাতে গ্রামের লোকজন যেন প্রতারিত না হয় এবং তাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়। এই জন্যে অন্যান্য দেশের বিজনেস মডেল থেকে একটু পরিবর্তন নিয়ে এসেছি আমরা। এজেন্ট পয়েন্টগুলোতে আমাদের লোকও আমরা বসাচ্ছি। সুতরাং আমাদের পর্যবেক্ষণ থাকে এজেন্টগুলোতে।
এক সময় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের হিড়িক পড়েছিল, এখন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের হিড়িক পড়েছে। এর কি সুফল নাকি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?
মো. আরফান আলী : প্রতিযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ তাতে ভোক্তা সহজে কম খরচে পণ্য পেতে পারে। প্রতিযোগীদের আমরা স্বাগত জানাই- এর সঙ্গে আসে দায়িত্ববোধ। দায়িত্বের সঙ্গে আমরা সার্ভিসটা ডেলিভারি করলাম কিনা? এখন দেখা গেল যে, শুধু একটা নতুন জিনিস নিয়ে নেমে গেছি তার রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো কনসিডার করছি না। অপারেশনাল রিস্ক, মানি লন্ডারিং এবং ফ্রড রিস্কজনিত অনেক কিছুই হতে পারে। সুতরাং এইগুলো মিটিগেট করেই নামা উচিত। তা না হলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে তখন ব্যাংকিং সেবা ব্যাহত হবে।
আপনারা ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কশপ করছেন?
মো. আরফান আলী : আমরা গেল তিন দিন ধরে ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কশপ করছি। এটা হচ্ছে- ওয়ার্ল্ড রিটেইল অ্যান্ড সেলিংস ব্যাংক, যা ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। এর হেড কোয়ার্টার বেলজিয়ামের ব্রাসেলস এ। তারা আমাদের দেশে এসেছেন তাদের সঙ্গে ৮ দেশের লোক এসেছে। ১৭টা ব্যাংক যারা এজেন্ট ব্যাংকিং করে তারা অংশ নিয়েছে। এর মাধ্যমে যা হয়েছে তা হলো- বাংলাদেশে ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন এর যে একটা কাজ চলছে এটি আমরা প্রদর্শনের সুযোগ পেলাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এই প্ল্যাটফর্ম ৭ হাজার ব্যাংকের- ওয়ার্ল্ড রিটেইল অ্যান্ড সেলিংস ব্যাংকিং অ্যাসোসিয়েশন। ওইখানে বাংলাদেশের ব্যাংকিংটাকে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এর সঙ্গে এজেন্ট ব্যাংকিং এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন এর কাজ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।